Showing posts with label চাঁদের পাহাড়. Show all posts

Showing posts with label চাঁদের পাহাড়. Show all posts

০৩. চাঁদের পাহাড় - তৃতীয় পরিচ্ছেদ

০৩. চাঁদের পাহাড় - তৃতীয় পরিচ্ছেদ

নতুন পদ পেয়ে উৎফুল্ল মনে শঙ্কর যখন স্টেশনটাতে এসে নামল, তখন বেলা তিনটে হবে। স্টেশনঘরটা খুব ছোট। মাটির প্ল্যাটফর্ম, প্ল্যাটফর্ম আর স্টেশনঘরের আশপাশ কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা। স্টেশনঘরের পিছনে তার থাকবার কোয়ার্টার। পায়রার খোপের মতো ছোট। যে ট্রেনখানা তাকে বহন করে এনেছিল, সেখানা কিসুমুর দিকে চলে গেল। শঙ্কর যেন অকুল সমুদ্রে পড়ল। এত নির্জন স্থান সে জীবনে কখনো কল্পনা করেনি। এই স্টেশনে সে-ই একমাত্র কর্মচারী। একটা কুলি পর্যন্ত নেই। সে-ই কুলি, সে-ই পয়েন্টসম্যান, সে-ই সব। এ রকম ব্যবস্থার কারণ হচ্ছে এই যে, এসব স্টেশন এখনো মোটেই আয়কর নয়। এর অস্তিত্ব এখনো পরীক্ষা-সাপেক্ষ। এদের পিছনে রেল কোম্পানী বেশি খরচ করতে রাজি নয়। একখানি ট্রেন সকালে, একখানি এই গেল— আর সারা দিনরাত্রে ট্রেন নেই। সুতরাং তার হাতে প্রচুর অবসর আছে। চার্জ বুঝে নিতে হবে এই একটু কাজ। আগের স্টেশনমাস্টারটি গুজরাটি, বেশ ইংরেজী জানে। সে নিজের হাতে চা করে নিয়ে এল। চার্জ বোঝাবার বেশি কিছু নেই। গুজরাটি ভদ্রলোক তাকে পেয়ে খুব খুশি। ভাবে বোধ হল সে কথা বলবার সঙ্গী পায়নি অনেকদিন। দু’জনে প্ল্যাটফর্মে এদিক ওদিক পায়চারি করলে। শঙ্কর বললে— কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা কেন? গুজরাটি ভদ্রলোকটি বললে— ও কিছু নয়। নির্জন জায়গা— তাই। শঙ্করের মনে হল কি একটা কথা লোকটা গোপন করে গেল। শঙ্করও আর পীড়াপীড়ি করলে না। রাত্রে ভদ্রলোক রুটি গড়ে শঙ্করকে খাবার নিমন্ত্রণ করলে। খেতে বসে হঠাৎ লোকটি চেঁচিয়ে উঠল— ঐ যাঃ, ভুলে গিয়েছি। - কি হল? - খাবার জল নেই মোটে, ট্রেন থেকে নিতে একদম ভুলে গিয়েছি। - সে কি? এখানে খাবার জল কোথাও পাওয়া যায় না? - কোথাও না। একটা কুয়ো আছে, তার জল বেজায় তেতো আর কষা। সে জলে বাসন মাজা ছাড়া আর কোনো কাজ হয় না। খাবার জল ট্রেন থেকে দিয়ে যায়। বেশ জায়গা বটে। খাবার জল নেই, মানুষজন নেই। এখানে স্টেশন করেছে কেন শঙ্কর বুঝতে পারলে না। পরদিন সকালে ভূতপূর্ব স্টেশনমাস্টার চলে গেল। শঙ্কর পড়ল একা। নিজের কাজ করে, রাঁধে খায়, ট্রেনের সময় প্ল্যাটফর্মে গিয়ে দাঁড়ায়। দুপুরে বই পড়ে কি বড় টেবিলটাতে শুয়ে ঘুমোয়। বিকেলের দিকে ছায়া পড়লে প্ল্যাটফর্মে পায়চারি করে। স্টেশনের চারিধার ঘিরে ধূ-ধূ সীমাহীন প্রান্তর, দীর্ঘ ঘাসের বন, মাঝে ইউকা, বাবলা গাছ— দূরে পাহাড়ের সারি সারা চক্রবাল জুড়ে। ভারি সুন্দর দৃশ্য। গুজরাটি লোকটি ওকে বারণ করে গিয়েছিল— একা যেন এই সব মাঠে সে না বেড়াতে বের হয়। শঙ্কর বলেছিল— কেন? সে প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর গুজরাটি ভদ্রলোকটির কাছ থেকে পাওয়া যায়নি। কিন্তু তার উত্তর অন্য দিক থেকে সে রাতেই মিলল। রাত বেশি না হতেই আহারাদি সেরে শঙ্কর স্টেশনঘরে বাতি জ্বালিয়ে বসে ডায়েরি লিখছে— স্টেশনঘরেই সে শোবে। সামনের কাঁচ বসানো দরজাটি বন্ধ আছে কিন্তু আগল দেওয়া নেই, কিসের শব্দ শুনে সে দরজার দিকে চেয়ে দেখে— দরজার ঠিক বাইরে কাঁচে নাক লাগিয়ে প্রকান্ড সিংহ! শঙ্কর কাঠের মতো বসে রইল। দরজা একটু জোর করে ঠেললেই খুলে যাবে। সেও সম্পূর্ণ নিরস্ত্র। টেবিলের ওপর কেবল কাঠের রুলটা মাত্র আছে। সিংহটা কিন্তু কৌতূহলের সঙ্গে শঙ্কর ও টেবিলের কেরোসিন বাতিটার দিকে চেয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। খুব বেশিক্ষণ ছিল না, হয়তো মিনিট দুই— কিন্তু শঙ্করের মনে হল সে আর সিংহটা কতকাল ধরে পরস্পর পরস্পরের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তারপর সিংহ ধীরে ধীরে অনাসক্ত ভাবে দরজা থেকে সরে গেল। শঙ্কর হঠাৎ যেন চেতনা ফিরে পেল। সে তাড়াতাড়ি গিয়ে দরজার আগলটা তুলে দিল। এতক্ষণে সে বুঝতে পারলে স্টেশনের চারিদিকে কাঁটাতারের বেড়া কেন। কিন্তু শঙ্কর একটু ভুল করেছিল— সে আংশিক ভাবে বুঝেছিল মাত্র, বাকি উত্তরটা পেতে দু- একদিন বিলম্ব ছিল। সেটা এল অন্য দিক থেকে। পরদিন সকালের ট্রেনের গার্ডকে সে রাত্রের ঘটনাটা বললে। গার্ড লোকটি ভালো, সব শুনে বললে— এসব অঞ্চলে সর্বত্রই এমন অবস্থা। এখান থেকে বারো মাইল দূরে তোমার মতো আর একটা স্টেশন আছে— সেখানেও এই দশা। এখানে তো যে কান্ড— সে কি একটা কথা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু হঠাৎ কথা বন্ধ করে ট্রেনে উঠে পড়ল। যাবার সময় চলন্ত ট্রেন থেকে বলে গেল— বেশ সাবধানে থেক সর্বদা। শঙ্কর চিন্তিত হয়ে পড়ল— এরা কী কথাটা চাপা দিতে চায়? সিংহ ছাড়া আরও কিছু আছে নাকি? যাহোক, সেদিন থেকে শঙ্কর প্ল্যাটফর্মে স্টেশনঘরের সামনে রোজ আগুন জ্বালিয়ে রাখে। সন্ধ্যার আগেই দরজা বন্ধ করে স্টেশনঘরে ঢোকে— অনেক রাত পর্যন্ত বসে পড়াশুনা করে বা ডায়েরি লেখে। রাত্রের অভিজ্ঞতা অদ্ভুত। বিস্তৃত প্রান্তরে ঘন অন্ধকার নামে, প্ল্যাটফর্মের ইউকা গাছটার ডালপালার মধ্যে দিয়ে রাত্রির বাতাস বেধে কেমন একটা শব্দ হয়, মাঠের মধ্যে প্রহরে প্রহরে শেয়াল ডাকে, এক একদিন গভীর রাতে দূরে কোথাও সিংহের গর্জন শুনতে পাওয়া যায়— অদ্ভুত জীবন! ঠিক এই জীবনই সে চেয়েছিল। এ তার রক্তে আছে। এই জনহীন প্রান্তর, এই রহস্যময়ী রাত্রি, অচেনা নক্ষত্রে ভরা আকাশ, এই বিপদের আশঙ্কা— এই তো জীবন! নিরাপদ শান্ত জীবন নিরীহ কেরানির হতে পারে— তার নয়। সেদিন বিকেলের ট্রেন রওনা করে দিয়ে সে নিজের কোয়ার্টারের রান্নাঘরে ঢুকতে যাচ্ছে এমন সময় খুঁটির গায়ে কি একটা দেখে সে তিন হাত লাফ দিয়ে পিছিয়ে এল— প্রকান্ড একটা হলদে খরিশ গোখরো তাকে দেখে ফণা উদ্যত করে খুঁটি থেকে প্রায় এক হাত বাইরে মুখ বাড়িয়েছে! আর দু’সেকেন্ড পরে যদি শঙ্করের চোখ সেদিকে পড়ত— তাহলে— না, এখন সাপটাকে মারবার কি করা যায়? কিন্তু সাপটা পরমুহূর্তে খুঁটি বেয়ে উপরে খড়ের চালের মধ্যে লুকিয়ে পড়ল। বেশ কান্ড বটে। ঐ ঘরে গিয়ে শঙ্করকে এখন ভাত রাঁধতে বসতে হবে। এ সিংহ নয় যে দরজা বন্ধ করে আগুন জ্বেলে রাখবে। খানিকটা ইতস্ততঃ করে শঙ্কর অগত্যা রান্নাঘরে ঢুকল এবং কোনোরকমে তাড়াতাড়ি রান্না সেরে সন্ধ্যা হবার আগেই খাওয়া-দাওয়া সাঙ্গ করে সেখান থেকে বেরিয়ে স্টেশনঘরে এল। কিন্তু স্টেশনঘরেই বা বিশ্বাস কি? সাপ কখন কোন ফাঁক দিয়ে ঘরে ঢুকবে, তাকে কি আর ঠেকিয়ে রাখা যাবে? পরদিন সকালের ট্রেনে গার্ডের গাড়ি থেকে একটি নতুন কুলি তার রসদের বস্তা নামিয়ে দিতে এল। সপ্তাহে দু’দিন মোম্বাসা থেকে চাল আর আলু রেল কোম্পানী এইসব নির্জন স্টেশনের কর্মচারীদের পাঠিয়ে দেয়— মাসিক বেতন থেকে এর দাম কেটে নেওয়া হয়। যে কুলিটা রসদের বস্তা নামিয়ে দিতে এল সে ভারতীয়, গুজরাট অঞ্চলে বাড়ি। বস্তাটা নামিয়ে সে কেমন যেন অদ্ভুত ভাবে চাইলে শঙ্করের দিকে, এবং পাছে শঙ্কর তাকে কিছু জিজ্ঞেস করে, এই ভয়েই যেন তাড়াতাড়ি গাড়িতে গিয়ে উঠে পড়ল। কুলির সে দৃষ্টি শঙ্করের চোখ এড়ায়নি। কী রহস্য জড়িত আছে যেন এই জায়গাটার সঙ্গে, কেউ তা ওর কাছে প্রকাশ করতে চায় না। প্রকাশ করা যেন বারণ আছে। ব্যাপার কী? দিন দুই পরে ট্রেন পাশ করে সে নিজের কোয়ার্টারে ঢুকতে যাচ্ছে— আর একটু হলে সাপের ঘাড়ে পা দিয়েছিল আর কি। সেই খরিশ গোখরো সাপ। পূর্বদৃষ্ট সাপটাও হতে পারে, নতুন একটা যে নয় তারও কোনো প্রমাণ নেই। শঙ্কর সেই দিন স্টেশনঘর, নিজের কোয়ার্টার ও চারধারের জমি ভালো করে পরীক্ষা করে দেখলে। সারা জায়গায় মাটিতে বড় বড় গর্ত, কোয়ার্টারের উঠোনে, রান্নাঘরের দেওয়ালে, কাঁচা প্ল্যাটফর্মের মাঝে মাঝে সর্বত্র গর্ত ও ফাটল আর ইঁদুরের মাটি। তবুও সে কিছু বুঝতে পারলে না। একদিন সে স্টেশনঘরে ঘুমিয়ে আছে, রাত অনেক। ঘর অন্ধকার, হঠাৎ শঙ্করের ঘুম ভেঙে গেল। পাঁচটা ইন্দ্রিয়ের বাইরে আর একটা কোনো ইন্দ্রিয় যেন মুহূর্তের জন্যে জাগরিত হয়ে উঠে তাকে জানিয়ে দিলে সে ভয়ানক বিপদে পড়বে। ঘোর অন্ধকার, শঙ্করের সমস্ত শরীর যেন শিউরে উঠল। টর্চটা হাতড়ে পাওয়া যায় না কেন? অন্ধকারের মধ্যে যেন একটা কিসের অস্পষ্ট শব্দ হচ্ছে ঘরের মধ্যে। হঠাৎ টর্চটা তার হাতে ঠেকল, এবং কলের পুতুলের মতো সে সামনের দিকে ঘুরিয়ে টর্চটা জ্বাললে। সঙ্গে সঙ্গেই সে ভয়ে বিস্ময়ে কাঠ হয়ে টর্চটা ধরে বিছানার উপরেই বসে রইল। দেওয়াল ও তার বিছানার মাঝামাঝি জায়গায় মাথা উঁচু করে তুলে ও টর্চের আলো পড়ার দরুন সাময়িক ভাবে আলো-আঁধারি লেগে থ খেয়ে আছে আফ্রিকার ক্রুর ও হিংস্রতম সাপ— কালো মাম্বা। ঘরের মেঝে থেকে সাপটা প্রায় আড়াই হাত উঁচু হয়ে উঠেছে— এটা এমন কিছু আশ্চর্য নয় যখন ব্ল্যাক মাম্বা সাধারণত মানুষকে তাড়া করে তার ঘাড়ে ছোবল মারে! ব্ল্যাক মাম্বার হাত থেকে রেহাই পাওয়া এক রকম পুনর্জন্ম তাও শঙ্কর শুনেছে। শঙ্করের একটা গুন বাল্যকাল থেকেই আছে, বিপদে তার সহজে বুদ্ধিভ্রংশ হয় না— আর তার স্নায়ুমন্ডলীর উপর সে ঘোর বিপদেও কর্তৃত্ব বজায় রাখতে পারে। শঙ্কর বুঝলে হাত যদি তার একটু কেঁপে যায়— তবে যে মুহূর্তে সাপটার চোখ থেকে আলো সরে যাবে— সেই মুহূর্তে ওর আলো- আঁধারি কেটে যাবে এবং তখুনি সে করবে আক্রমণ। সে বুঝলে তার আয়ু নির্ভর করছে এখন দৃঢ় ও অকম্পিত হাতে টর্চটা সাপের চোখের দিকে ধরে থাকবার উপর। যতক্ষণ সে এরকম ধরে থাকতে পারবে ততক্ষণ সে নিরাপদ। কিন্তু যদি টর্চটা একটু এদিক ওদিক সরে যায়… শঙ্কর টর্চ ধরেই রইল। সাপের চোখ দুটো জ্বলছে যেন দুটো আলোর দানার মতো। কি ভীষণ শক্তি ও রাগ প্রকাশ পাচ্ছে চাবুকের মতো খাড়া উদ্যত তার কালো মিশমিশে সরু দেহটাতে। শঙ্কর ভুলে গেছে চারপাশের সব আসবাবপত্র, আফ্রিকা দেশটা, তার রেলের চাকরি, মোম্বাসা থেকে কিসুমু লাইনটা, তার দেশ, তার বাবা-মা— সমস্ত জগৎটা শূন্য হয়ে গিয়ে সামনের ঐ দুটো জ্বলজ্বলে আলোর দানায় পরিণত হয়েছে… তার বাইরে সব শূন্য! অন্ধকার! মৃত্যুর মতো শূন্য, প্রলয়ের পরের বিশ্বের মতো অন্ধকার! সত্য কেবল এই মহাহিংস্র উদ্যতফণা মাম্বা, যেটা প্রত্যেক ছোবলে ১৫০০ মিলিগ্রাম তীব্র বিষ ক্ষতস্থানে ঢুকিয়ে দিতে পারে এবং দেবার জন্যে ওৎ পেতে রয়েছে… শঙ্করের হাত ঝিমঝিম করছে, আঙুল অবশ হয়ে আসছে, কনুই থেকে বগল পর্যন্ত হাতের যেন সাড় নেই। কতক্ষণ সে আর টর্চ ধরে থাকবে? আলোর দানা দুটো হয়তো সাপের চোখ নয়… জোনাকি পোকা কিংবা নক্ষত্র… কিংবা… টর্চের ব্যাটারির তেজ কমে আসছে না? সাদা আলো যেন হলদে ও নিস্তেজ হয়ে আসছে না? … কিন্তু জোনাকি পোকা কিংবা নক্ষত্র দুটো তেমনি জ্বলছে। রাত না দিন? ভোর হবে না সন্ধ্যা হবে? শঙ্কর নিজেকে সামলে নিলে। ওই চোখ দুটোর জ্বালাময়ী দৃষ্টি তাকে যেন মোহগ্রস্ত করে তুলছে। সে সজাগ থাকবে। এ তেপান্তরের মাঠে চেঁচালেও কেউ কোথাও নেই সে জানে— তার নিজের স্নায়ুমন্ডলীর দৃঢ়তার উপর নির্ভর করছে তার জীবন। কিন্তু সে পারছে না যে, হাত যেন টনটন করে অবশ হয়ে আসছে, আর কতক্ষণ সে টর্চ ধরে থাকবে? সাপে না হয় ছোবল দিক কিন্তু হাতখানা একটু নামিয়ে সে আরাম বোধ করবে এখন। তারপরেই ঘড়িতে টং টং করে তিনটে বাজল। ঠিক রাত তিনটে পর্যন্তই বোধহয় শঙ্করের আয়ু ছিল, কারণ তিনটে বাজবার সঙ্গে সঙ্গে তার হাত কেঁপে উঠে নড়ে গেল— সামনের আলোর দানা দুটো গেল নিভে। কিন্তু সাপ কই? তাড়া করে এল না কেন? পরক্ষণেই শঙ্কর বুঝতে পারলে সাপটাও সাময়িক মোহগ্রস্ত হয়েছে তার মতো। এই অবসর! বিদ্যুতের চেয়েও বেগে সে টেবিল থেকে একলাফ মেরে অন্ধকারের মধ্যে দরজার আগল খুলে ফেলে ঘরের বাইরে গিয়ে দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ করে দিলে। সকালের ট্রেন এল। শঙ্কর বাকি রাতটা প্ল্যাটফর্মেই কাটিয়েছে। ট্রেনের গার্ডকে বললে সব ব্যাপার। গার্ড বললে— চলো দেখি স্টেশনঘরের মধ্যে। ঘরের মধ্যে কোথাও সাপের চিহ্নও পাওয়া গেল না। গার্ড লোকটা ভালো, বললে— বলি তবে শোনো। খুব বেঁচে গিয়েছ কাল রাত্রে। এতদিন কথাটা তোমায় বলিনি, পাছে ভয় পাও। তোমার আগে যিনি স্টেশনমাস্টার এখানে ছিলেন— তিনিও সাপের উপদ্রবেই এখান থেকে পালান। তাঁর আগে দু’জন স্টেশনমাস্টার এই স্টেশনের কোয়ার্টারে সাপের কামড়ে মরেছে। আফ্রিকার ব্ল্যাক মাম্বা যেখানে থাকে, তার ত্রিসীমানায় লোক আসে না। বন্ধুভাবে কথাটা বললাম, উপরওয়ালাদের বলো না যেন যে আমার কাছ থেকে এ কথা শুনেছ। ট্রান্সফারের দরখাস্ত কর। শঙ্কর বললে— দরখাস্তের উত্তর আসতেও তো দেরি হবে, তুমি একটা উপকার কর। আমি এখানে একেবারে নিরস্ত্র, আমাকে একটা বন্দুক কি রিভলবার যাবার পথে দিয়ে যেও। আর কিছু কার্বলিক অ্যাসিড। ফিরবার পথেই কার্বলিক অ্যাসিডটা আমায় দিয়ে যেও। ট্রেন থেকে সে একটা কুলিকে নামিয়ে নিলে এবং দু’জনে মিলে সারাদিন সর্বত্র গর্ত বুজিয়ে বেড়ালে। পরীক্ষা করে দেখে মনে হল কাল রাত্রে স্টেশনঘরের পশ্চিমের দেওয়ালের কোণে একটা গর্ত থেকে সাপটা বেরিয়েছিল। গর্তগুলো ইঁদুরের, বাইরের সাপ দিনমানে ইঁদুর খাওয়ার লোভে গর্তে ঢুকেছিল হয়তো। গর্তটা বেশ ভালো করে বুজিয়ে দিলে। ডাউন ট্রেনের গার্ডের কাছ থেকে এক বোতল কার্বলিক অ্যাসিড পাওয়া গেল— ঘরের সর্বত্র সে অ্যাসিড ছড়িয়ে দিলে। কুলিটা তাকে একটা বড় লাঠি দিয়ে গেল। দু- তিনদিনের মধ্যেই রেল কোম্পানী থেকে ওকে একটা বন্দুক দিলে।

Posted by
Unknown

More

০১. চাঁদের পাহাড় – প্রথম পরিচ্ছেদ

০১. চাঁদের পাহাড় – প্রথম পরিচ্ছেদ শঙ্কর একেবারে অজ পাড়াগাঁয়ের ছেলে। এইবার সে সবে এফ.এ. পাশ দিয়ে গ্রামে বসেছে। কাজের মধ্যে সকালে বন্ধুবান্ধবদের বাড়িতে গিয়ে আড্ডা দেওয়া, দুপুরে আহারান্তে লম্বা ঘুম, বিকেলে পালঘাটের বাঁওড়ে মাছ ধরতে যাওয়া। সারা বৈশাখ এইভাবে কাটবার পরে একদিন তার মা ডেকে বললেন— শোন একটা কথা বলি শঙ্কর। তোর বাবার শরীর ভালো নয়। এ অবস্থায় আর তোর পড়াশুনো হবে কী করে? কে খরচ দেবে? এইবার একটা কিছু কাজের চেষ্টা দ্যাখ। মায়ের কথাটা শঙ্করকে ভাবিয়ে তুললে। সত্যিই তার বাবার শরীর আজ ক’মাস থেকে খুব খারাপ যাচ্ছে। কলকাতার খরচ দেওয়া তাঁর পক্ষে ক্রমেই অসম্ভব হয়ে উঠছে। অথচ করবেই বা কী শঙ্কর? এখন কি তাকে কেউ চাকুরি দেবে? চেনেই বা সে কাকে? আমরা যে সময়ের কথা বলছি, ইউরোপের মহাযুদ্ধ বাধতে তখনও পাঁচ বছর দেরি। ১৯০৯ সালের কথা। তখন চাকুরির বাজার এতটা খারাপ ছিল না। শঙ্করদের গ্রামের এক ভদ্রলোক শ্যামনগরে না নৈহাটিতে পাটের কলে চাকুরি করতেন। শঙ্করের মা তাঁর স্ত্রীকে ছেলের চাকুরির কথা বলে এলেন, যাতে তিনি স্বামীকে বলে শঙ্করের জন্যে পাটের কলে একটা কাজ যোগাড় করে দিতে পারেন। ভদ্রলোক পরদিন বাড়ি বয়ে বলতে এলেন যে শঙ্করের চাকুরির জন্যে তিনি চেষ্টা করবেন। শঙ্কর সাধারণ ধরণের ছেলে নয়। স্কুলে পড়বার সময় সে বরাবর খেলাধুলোতে প্রথম হয়ে এসেছে। সেবার মহকুমার এক্‌জিবিশনের সময় হাইজাম্পে সে প্রথম স্থান অধিকার করে মেডেল পায়। ফুটবলে অমন সেন্টার ফরওয়ার্ড ও অঞ্চলে তখন কেউ ছিল না। সাঁতার দিতে তার জুড়ি খুঁজে মেলা ভার। গাছে উঠতে, ঘোড়ায় চড়তে, বক্সিং-এ সে অত্যন্ত নিপুণ। কলকাতায় পড়বার সময় ওয়াই.এম.সি.এ. তে সে রীতিমতো বক্সিং অভ্যাস করেছে। এই সব কারণে পরীক্ষায় সে তত ভালো করতে পারেনি, দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছিল। কিন্তু তার একটি বিষয়ে অদ্ভুত জ্ঞান ছিল। তার বাতিক ছিল যত রাজ্যের ম্যাপ ঘাঁটা ও বড় বড় ভূগোলের বই পড়া। ভূগোলের অঙ্ক কষতে সে খুব মজবুত। আমাদের দেশের আকাশে যে সব নক্ষত্রমণ্ডলী ওঠে, তা সে প্রায় সবই চেনে— ওটা কালপুরুষ, ওটা সপ্তর্ষি, ওটা ক্যাসিওপিয়া, ওটা বৃশ্চিক। কোন মাসে কোনটা ওঠে, কোন দিকে ওঠে— সব ওর নখদর্পণে। আকাশের দিকে চেয়ে তখুনি বলে দেবে। আমাদের দেশের বেশি ছেলে যে এসব জানে না, এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে। এবার পরীক্ষা দিয়ে কলকাতা থেকে আসবার সময় সে একরাশ ওই সব বই কিনে এনেছে, নির্জনে বসে প্রায়ই পড়ে আর কী ভাবে ওই জানে। তারপর এল তার বাবার অসুখ, সংসারের দারিদ্র্য এবং সঙ্গে সঙ্গে মায়ের মুখে পাটকলে চাকুরি নেওয়ার জন্যে অনুরোধ। কী করবে সে? সে নিতান্ত নিরুপায়। মা-বাপের মলিন মুখ সে দেখতে পারবে না। অগত্যা তাকে পাটের কলেই চাকুরি নিতে হবে। কিন্তু জীবনের স্বপ্ন তাহলে ভেঙে যাবে, তাও সে যে না বোঝে এমন নয়। ফুটবলের নাম করা সেন্টার ফরওয়ার্ড, জেলার হাইজাম্প চ্যাম্পিয়ান, নামজাদা সাঁতারু শঙ্কর হবে কিনা শেষে পাটের কলের বাবু; নিকেলের বইয়ের আকারের কৌটোতে খাবার কি পান নিয়ে ঝাড়ন পকেটে করে তাকে সকালের ভোঁ বাজতেই ছুটতে হবে কলে, আবার বারোটার সময় এসে দুটো খেয়ে নিয়েই আবার রওনা— ওদিকে সেই ছ’টার ভোঁ বাজলে ছুটি। তার তরুণ তাজা মন এর কথা ভাবতেই পারে না যে। ভাবতে গেলেই তার সারা দেহ-মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে— রেসের ঘোড়া শেষকালে ছ্যাকরা গাড়ি টানতে যাবে? সন্ধ্যার বেশি দেরি নেই। নদীর ধারে নির্জনে বসে-বসে শঙ্কর এইসব কথাই ভাবছিল। তার মন উড়ে যেতে চায় পৃথিবীর দূর, দূর দেশে— শত দুঃসাহসিক কাজের মাঝখানে। লিভিংস্টোন, স্ট্যানলির মতো, হ্যারি জনস্টন, মার্কো পোলো, রবিনসন ক্রুসোর মতো। এর জন্যে ছেলেবেলা থেকে সে নিজেকে তৈরি করেছে— যদিও এ কথা ভেবে দেখেনি অন্য দেশের ছেলেদের পক্ষে যা ঘটতে পারে, বাঙালী ছেলেদের পক্ষে তা ঘটা এক রকম অসম্ভব। তারা তৈরি হয়েছে কেরানি, স্কুলমাস্টার, ডাক্তার বা উকিল হবার জন্যে। অজ্ঞাত অঞ্চলের অজ্ঞাত পথে পাড়ি দেওয়ার আশা তাদের পক্ষে নিতান্তই দুরাশা। প্রদীপের মৃদু আলোয় সেদিন রাত্রে সে ওয়েস্টমার্কের বড় ভূগোলের বইখানা খুলে পড়তে বসল। এই বইখানার একটা জায়গা তাকে বড় মুগ্ধ করে। সেটা হচ্ছে প্রসিদ্ধ জার্মান পর্যটক অ্যাণ্টন হাউপ্টমান লিখিত আফ্রিকার একটা বড় পর্বত— মাউনটেন অফ দি মুন (চাঁদের পাহাড়) আরোহণের অদ্ভুত বিবরণ। কতবার সে এটা পড়েছে। পড়বার সময় কতবার ভেবেছে হের হাউপ্টমানের মতো সেও একদিন যাবে মাউনটেন অফ দি মুন জয় করতে। স্বপ্ন! সত্যিকার চাঁদের পাহাড় দূরের জিনিসই চিরকাল। চাঁদের পাহাড় বুঝি পৃথিবীতে নামে? সে রাত্রে বড় অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখল সে… চারধারে ঘন বাঁশের জঙ্গল। বুনো হাতির দল মড় মড় করে বাঁশ ভাঙছে। সে আর একজন কে তার সঙ্গে, দু’জনে একটা প্রকাণ্ড পাহাড়ে উঠছে, চারধারের দৃশ্য ঠিক হাউপ্টমানের লেখা মাউনটেন অফ দি মুনের দৃশ্যের মতো। সেই ঘন বাঁশ বন, সেই পরগাছা ঝোলানো বড় বড় গাছ, নিচে পচাপাতার রাশ, মাঝে মাঝে পাহাড়ের খালি গা, আর দূরে গাছপালার ফাঁকে জ্যোৎস্নায় ধোয়া সাদা ধবধবে চিরতূষারে ঢাকা পর্বতশিখরটি— এক একবার দেখা যাচ্ছে, এক একবার বনের আড়ালে চাপা পড়ছে। পরিষ্কার আকাশে দু-একটি তারা এখানে ওখানে। একবার সত্যিই সে যেন বুনো হাতির গর্জন শুনতে পেলে। সমস্ত বনটা কেঁপে উঠল… এত বাস্তব বলে মনে হল সেটা, যেন সেই ডাকেই তার ঘুম ভেঙে গেল! বিছানার উপর উঠে বসল, ভোর হয়ে গিয়েছে, জানালার ফাঁক দিয়ে দিনের আলো ঘরের মধ্যে এসেছে। উঃ, কি স্বপ্নটাই দেখেছে সে! ভোরের স্বপ্ন নাকি সত্যি হয়, বলে তো অনেকে। অনেকদিন আগের একটি ভাঙা পুরনো মন্দির আছে তাদের গাঁয়ে। বার ভূঁইয়ার এক ভূঁইয়ার জামাই মদন রায় নাকি প্রাচীন দিনে এই মন্দির তৈরি করেন। এখন মদন রায়ের বংশে কেউ নেই। মন্দির ভেঙেচুরে গিয়েছে, অশ্বত্থ গাছ, বটগাছ গজিয়েছে কার্নিসে— কিন্তু যেখানে ঠাকুরের বেদী তার উপরের খিলেনটা এখনো ঠিক আছে। কোনো মূর্তি নেই, তবুও শনি-মঙ্গলবারে পূজো হয়, মেয়েরা বেদীতে সিঁদুর-চন্দন মাখিয়ে রেখে যায়। সবাই বলে ঠাকুর বড় জাগ্রত, যে যা মানত করে তাই হয়। শঙ্কর সেদিন স্নান করে উঠে মন্দিরের একটা বটের ঝুরির গায়ে একটা ঢিল ঝুলিয়ে কি প্রার্থনা জানিয়ে এলে। বিকেলে সে গিয়ে অনেকক্ষণ মন্দিরের সামনে দূর্বাঘাসের বনে বসে রইল। জায়গাটা পাড়ার মধ্যে হলেও বনে ঘেরা, কাছেই একটা পোড়ো বাড়ি; এদের বাড়িতে একটা খুন হয়ে গিয়েছিল শঙ্করের শিশুকালে— সেই থেকে বাড়ির মালিক এ গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র বাস করছেন; সবাই বলে জায়গাটায় ভূতের ভয়। একা কেউ এদিকে আসে না। শঙ্করের কিন্তু এই নির্জন মন্দির প্রাঙ্গণের নিরালা বনে চুপ করে বসে থাকতে বড় ভালো লাগে। ওর মনে আজ ভোরের স্বপ্নটা দাগ কেটে বসে গিয়েছে। এই বনের মধ্যে বসে শঙ্করের আবার সেই ছবিটা মনে পড়ল— সেই মড় মড় করে বাঁশঝাড় ভাঙছে বুনো হাতির দল, পাহাড়ের অধিত্যকার নিবিড় বনে পাতা-লতার ফাঁকে ফাঁকে অনেক উঁচুতে পর্বতের জ্যোৎস্নাপাণ্ডুর তুষারাবৃত শিখরদেশটা যেন কোন স্বপ্নরাজ্যের সীমা নির্দেশ করছে। কত স্বপ্ন তো সে দেখেছে জীবনে— অত সুস্পষ্ট ছবি স্বপ্নে সে দেখেনি কখনো— এমন গভীর রেখাপাত করেনি কোনো স্বপ্ন তার মনে। সব মিথ্যে! তাকে যেতে হবে পাটের কলে চাকরি করতে। তাই তার ললাট-লিপি, নয় কি? কিন্তু মানুষের জীবনে এমন সব অদ্ভুত ঘটনা ঘটে যা উপন্যাসে ঘটাতে গেলে পাঠকেরা বিশ্বাস করতে চাইবে না, হেসেই উড়িয়ে দেবে। শঙ্করের জীবনেও এমন একটি ঘটনা সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ভাবে ঘটে গেল। সকালবেলা সে একটু নদীর ধারে বেড়িয়ে এসে সবে বাড়িতে পা দিয়েছে, এমন সময় ওপাড়ার রামেশ্বর মুখুয্যের স্ত্রী একটুকরো কাগজ নিয়ে এসে তার হাতে দিয়ে বললেন— বাবা শঙ্কর, আমার জামায়ের খোঁজ পাওয়া গেছে অনেকদিন পরে। ভদ্রেশ্বরে ওদের বাড়িতে চিঠি দিয়েছে, কাল পিন্টু সেখান থেকে এসেছে, এই তার ঠিকানা তারা লিখে দিয়েছে। পড় তো বাবা। শঙ্কর বললে— উঃ, প্রায় দু’বছরের পর খোঁজ মিলল। বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে কি ভয়টাই দেখালেন। এর আগেও তো একবার পালিয়ে গিয়েছিলেন— না? তারপর সে কাগজটা খুললে। লেখা আছে— প্রসাদদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, ইউগাণ্ডা রেলওয়ে হেড অফিস, কনস্ট্রাকশন ডিপার্টমেন্ট, মোম্বাসা, পূর্ব-আফ্রিকা। শঙ্করের হাত থেকে কাগজের টুকরোটা পড়ে গেল। পূর্ব-আফ্রিকা! পালিয়ে মানুষে এতদূর যায়? তবে সে জানে ননীবালা দিদির এই স্বামী অত্যন্ত একরোখা ডানপিটে ও ভবঘুরে ধরণের। একবার এই গ্রামেই তার সঙ্গে শঙ্করের আলাপও হয়েছিল— শঙ্কর তখন এন্ট্রান্স ক্লাসে সবে উঠেছে। লোকটা খুব উদার প্রকৃতির, লেখাপড়া ভালোই জানে, তবে কোনো একটা চাকুরিতে বেশিদিন টিকে থাকতে পারে না, উড়ে বেড়ানো স্বভাব। আর একবার পালিয়ে বর্মা না কোচিন কোথায় যেন গিয়েছিল। এবারও বড়দাদার সঙ্গে কি নিয়ে মনোমালিন্য হওয়ার দরুন বাড়ি থেকে পালিয়েছিল— এ খবর শঙ্কর আগেই শুনেছিল। সেই প্রসাদবাবু পালিয়ে গিয়ে ঠেলে উঠেছেন একেবারে পূর্ব-আফ্রিকায়! রামেশ্বর মুখুয্যের স্ত্রী ভালো বুঝতে পারলেন না তাঁর জামাই কত দূরে গিয়েছে। অতটা দূরত্বের তাঁর ধারনা ছিল না। তিনি চলে গেলে শঙ্কর ঠিকানাটা নিজের নোট বইয়ে লিখে রাখলে এবং সেই সপ্তাহের মধ্যেই প্রসাদবাবুকে একখানা চিঠি দিলে। শঙ্করকে তাঁর মনে আছে কি? তাঁর শ্বশুরবাড়ির গাঁয়ের ছেলে সে। এবার এফ.এ. পাশ দিয়ে বাড়িতে বসে আছে। তিনি কি একটা চাকুরি করে দিতে পারেন তাঁদের রেলের মধ্যে? যতদূরে হয় সে যাবে। দেড়মাস পরে, যখন শঙ্কর প্রায় হতাশ হয়ে পড়েছে চিঠির উত্তর প্রাপ্তি সম্বন্ধে— তখন একখানা খামের চিঠি এল শঙ্করের নামে। তাতে লেখা আছে— মোম্বাসা ২ নং পোর্ট স্ট্রীট প্রিয় শঙ্কর, তোমার পত্র পেয়েছি। তোমাকে আমার খুব মনে আছে। কব্জির জোরে তোমার কাছে সেবার হেরে গিয়েছিলুম, সে কথা ভুলিনি। তুমি আসবে এখানে? চলে এসো। তোমার মতো ছেলে যদি বাইরে না বেরুবে তবে কে আর বেরুবে? এখানে নতুন রেল তৈরি হচ্ছে, আরও লোক নেবে। যত তাড়াতাড়ি পারো এসো। তোমার কাজ জুটিয়ে দেবার ভার আমি নিচ্ছি। তোমাদের— প্রসাদদাস বন্দ্যোপাধ্যায় শঙ্করের বাবা চিঠি দেখে খুব খুশি। যৌবনে তিনি নিজেও ছিলেন ডানপিটে ধরণের লোক। ছেলে পাটের কলে চাকুরি করতে যাবে এতে তাঁর মত ছিল না, শুধু সংসারের অভাব অনটনের দরুন শঙ্করের মায়ের মতেই সায় দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। এর মাস খানেক পরে শঙ্করের নামে এক টেলিগ্রাম এল ভদ্রেশ্বর থেকে। সেই জামাইটি দেশে এসেছেন সম্প্রতি। শঙ্কর যেন গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করে টেলিগ্রাম পেয়েই। তিনি আবার মোম্বাসায় ফিরবেন দিন কুড়ির মধ্যে। শঙ্করকে তাহলে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারেন।

Posted by
Unknown

More

০২. চাঁদের পাহাড় - দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

০২. চাঁদের পাহাড় - দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ


চার মাস পরের ঘটনা। মার্চ মাসের শেষ।

মোম্বাসা থেকে রেলপথ গিয়েছে কিসুমু-
ভিক্টোরিয়া নায়ানজা হ্রদের ধারে— তারই
একটা শাখা লাইন তখন তৈরি হচ্ছিল।
জায়গাটা মোম্বাসা থেকে সাড়ে তিনশো মাইল
পশ্চিমে। ইউগাণ্ডা রেলওয়ের নুডসবার্গ স্টেশন
থেকে বাহাত্তর মাইল দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে।
এখানে শঙ্কর কনস্ট্রাকশন ক্যাম্পের কেরানি ও
সরকারি স্টোরকিপার হয়ে এসেছে। থাকে ছোট
একটা তাঁবুতে। তার আশেপাশে অনেক তাঁবু।
এখানে এখনও বাড়িঘর
তৈরি হয়নি বলে তাঁবুতেই সবাই থাকে।
তাঁবুগুলো একটা খোলা জায়গায়
চক্রাকারে সাজানো— তাদের চারধার ঘিরে বহু
দূরব্যাপী মুক্ত প্রান্তর,
লম্বা লম্বা ঘাসে ভরা, মাঝে মাঝে গাছ।
তাঁবুগুলোর ঠিক গায়েই খোলা জায়গার শেষ
সীমায় একটা বড় বাওবাব গাছ। আফ্রিকার
বিখ্যাত গাছ, শঙ্কর কতবার ছবিতে দেখেছে,
এবার সত্যিকার বাওবাব দেখে শঙ্করের যেন আশ
মেটে না।
নতুন দেশ, শঙ্করের তরুণ তাজা মন—
সে ইউগান্ডার এই নির্জন মাঠ ও বনে নিজের
স্বপ্নের সার্থকতাকে যেন খুঁজে পেলে। কাজ শেষ
হয়ে যেতেই সে তাঁবু থেকে রোজ বেরিয়ে পড়তো—
যেদিকে দু’চোখ যায় সেদিকে বেড়াতে বের হত—
পুবে, পশ্চিমে, দক্ষিণে, উত্তরে। সব দিকেই
লম্বা লম্বা ঘাস। কোথাও মানুষের মাথা সমান
উঁচু, কোথাও তার চেয়েও উঁচু।
কনস্ট্রাকশন তাঁবুর ভারপ্রাপ্ত এঞ্জিনিয়ার
সাহেব একদিন শঙ্করকে ডেকে বললেন—
শোনো রায়, ওরকম এখানে বেড়িও না।
বিনা বন্দুকে এখানে এক পা-ও যেও না। প্রথম—
এই ঘাসের জমিতে পথ হারাতে পারো। পথ
হারিয়ে লোকে এসব জায়গায় মারাও
গিয়েছে জলের অভাবে। দ্বিতীয়—
ইউগান্ডা সিংহের দেশ। এখানে আমাদের
সাড়াশব্দ আর হাতুড়ি ঠোকার আওয়াজে সিংহ
হয়তো একটু দূরে চলে গিয়েছে— কিন্তু ওদের
বিশ্বাস নেই। খুব সাবধান। এসব অঞ্চল মোটেই
নিরাপদ নয়।
একদিন দুপুরের পরে কাজকর্ম বেশ পুরোদমে চলছে,
হঠাৎ তাঁবু থেকে কিছুদূরে লম্বা ঘাসের জমির
মধ্যে মনুষ্যকণ্ঠের আর্তনাদ শোনা গেল। সবাই
সেদিকে ছুটে গেল ব্যাপার কী দেখতে। শঙ্করও
ছুটল। ঘাসের জমি পাতিপাতি করে খোঁজা হল—
কিছুই নেই সেখানে।
কিসের চিৎকার তবে?
এঞ্জিনিয়ার সাহেব এলেন। কুলিদের নামডাক
হল, দেখা গেল একজন কুলি অনুপস্থিত।
অনুসন্ধানে জানা গেল সে একটু আগে ঘাসের
বনের দিকে কি কাজে গিয়েছিল,
তাকে ফিরে আসতে কেউ দেখেনি।
খোঁজাখুঁজি করতে করতে ঘাসের বনের
বাইরে কটা বালির ওপরে সিংহের পায়ের দাগ
পাওয়া গেল। সাহেব বন্দুক নিয়ে লোকজন
সঙ্গে করে পায়ের দাগ দেখে অনেক দূর
গিয়ে একটা বড় পাথরের আড়ালে হতভাগ্য
কুলির রক্তাক্ত দেহ বার করলেন।
তাকে তাঁবুতে ধরাধরি করে নিয়ে আসা হল।
কিন্তু সিংহের কোনো চিহ্ন মিলল না। লোকজনের
চিৎকারে সে শিকার ফেলে পালিয়েছে। সন্ধ্যার
আগেই কুলিটা মারা গেল।
তাঁবুর চারপাশের লম্বা ঘাস অনেক দূর পর্যন্ত
কেটে সাফ করে দেওয়া হল পরদিনই। দিনকতক
সিংহের কথা ছাড়া তাঁবুতে আর কোনো গল্পই নেই।
তারপর মাসখানেক পরে ঘটনাটা পুরনো হয়ে গেল,
সে কথা সকলের মনে চাপা পড়ে গেল। কাজকর্ম
আবার বেশ চলল।
সেদিন দিনে খুব গরম। সন্ধ্যার একটু পরেই
কিন্তু ঠাণ্ডা পড়ল। কুলিদের তাঁবুর
সামনে কাঠকুটো জ্বালিয়ে আগুন করা হয়েছে।
সেখানে তাঁবুর সবাই গোল হয়ে বসে গল্পগুজব
করছে। শঙ্করও সেখানে আছে, সে ওদের গল্প
শুনছে এবং অগ্নিকুণ্ডের
আলোতে ‘কেনিয়া মর্নিং নিউজ’ পড়ছে। খবরের
কাগজখানা পাঁচদিনের পুরনো। কিন্তু এ জনহীন
প্রান্তরে তবু এখানাতে বাইরের দুনিয়ার
যা কিছু একটা খবর পাওয়া যায়।
তিরুমল আপ্পা বলে একজন
মাদ্রাজি কেরানির সঙ্গে শঙ্করের খুব বন্ধুত্ব
হয়েছিল। তিরুমল তরুণ যুবক, বেশ ইংরেজী জানে,
মনেও খুব উৎসাহ।
সে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে এ্যাডভেঞ্চারের
নেশায়। শঙ্করের পাশে বসে সে আজ
সন্ধ্যা থেকে ক্রমাগত দেশের কথা, তার বাপ-
মায়ের কথা, তার ছোট বোনের কথা বলছে। ছোট
বোনকে সে বড় ভালোবাসে। বাড়ি ছেড়ে এসে তার
কথাই তিরুমলের বড় মনে হয়। একবার সে দেশের
দিকে যাবে সেপ্টেম্বর মাসের শেষে। মাস দুই
ছুটি মঞ্জুর করবে না সাহেব?
ক্রমে রাত বেশি হল। মাঝে মাঝে আগুন
নিভে যাচ্ছে, আবার
কুলিরা তাতে কাঠকুটো ফেলে দিচ্ছে। আরও
অনেকে উঠে শুতে গেল। কৃষ্ণপক্ষের ভাঙা চাঁদ
ধীরে ধীরে দূর দিগন্তে দেখা দিল— সমগ্র
প্রান্তর জুড়ে আলো-আঁধারের লুকোচুরি আর
বুনো গাছের দীর্ঘ দীর্ঘ ছায়া।
শঙ্করের ভারি অদ্ভুত মনে হচ্ছিল বহুদূর
বিদেশের এই স্তব্ধ রাত্রির সৌন্দর্য। কুলিদের
ঘরের একটা খুঁটিতে হেলান
দিয়ে সে একদৃষ্টে সম্মুখের বিশাল জনহীন
তৃণভূমির আলো-আঁধারমাখা রূপের
দিকে চেয়ে চেয়ে কত কি ভাবছিল। ওই বাওবাব
গাছটার ওদিকে অজানা দেশের সীমা কেপটাউন
পর্যন্ত বিস্তৃত— মধ্যে পড়বে কত পর্বত, অরণ্য,
প্রাগৈতিহাসিক যুগের নগর জিম্বারি—
বিশাল ও বিভীষিকাময় কালাহারি মরুভূমি,
হীরকের দেশ, সোনার খনির দেশ!
একজন বড় স্বর্ণাণ্বেষী পর্যটক
যেতে যেতে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলেন।
যে পাথরটাতে লেগে হোঁচট খেলেন
সেটা হাতে তুলে ভালো করে পরীক্ষা করে দেখলেন,
তার সঙ্গে সোনা মেশানো রয়েছে। সে জায়গায় বড়
একটা সোনার খনি বেরিয়ে পড়ল। এ ধরণের কত
গল্প সে পড়েছে দেশে থাকতে।
এই সেই আফ্রিকা, সেই রহস্যময় মহাদেশ, সোনার
দেশ, হীরের দেশ— কত অজানা জাতি,
অজানা দৃশ্যাবলী, অজানা জীবজন্তু এর
সীমাহীন ট্রপিক্যাল অরণ্যে আত্মগোপন
করে আছে, কে তার হিসেব রেখেছে?
কত কি ভাবতে ভাবতে শঙ্কর কখন
ঘুমিয়ে পড়েছে। হঠাৎ কিসের শব্দে তার ঘুম
ভাঙল। সে ধড়মড় করে জেগে উঠে বসল। চাঁদ
আকাশে অনেকটা উঠেছে।
ধবধবে সাদা জ্যোৎস্না দিনের মতো পরিস্কার।
অগ্নিকুণ্ডের আগুন গিয়েছে নিভে। কুলিরা সব
কুন্ডলি পাকিয়ে আগুনের উপরে শুয়ে আছে।
কোনোদিকে কোনো শব্দ নেই।
হঠাৎ শঙ্করের দৃষ্টি পড়ল তার পাশে—
এখানে তো তিরুমল আপ্পা বসে তার সঙ্গে গল্প
করছিল। সে কোথায়? তাহলে সে তাঁবুর
মধ্যে ঘুমুতে গিয়ে থাকবে।
শঙ্করও নিজে উঠে শুতে যাবার উদ্যোগ করছে,
এমন সময়ে অল্প দূরেই পশ্চিম কোণে মাঠের
মধ্যে ভীষণ সিংহগর্জন শুনতে পাওয়া গেল।
রাত্রির অস্পষ্ট জ্যোৎস্নালোক যেন কেঁপে উঠল
সে রবে। কুলিরা ধড়মড় করে জেগে উঠল।
এঞ্জিনিয়ার সাহেব বন্দুক নিয়ে তাঁবুর
বাইরে এলেন। শঙ্কর জীবনে এই প্রথম শুনল
সিংহের গর্জন— সেই দিকদিশাহীন তৃণভূমির
মধ্যে শেষ রাত্রের জ্যোৎস্নায় সে গর্জন
যে কি এক অনির্দেশ্য অনুভূতি তার
মনে জাগালে! তা ভয় নয়, সে এক রহস্যময় জটিল
মনোভাব। একজন বৃদ্ধ মাসাই কুলি ছিল তাঁবুতে।
সে বললে— সিংহ লোক মেরেছে। লোক
না মারলে এমন গর্জন করবে না।
তাঁবুর ভিতর থেকে তিরুমলের সঙ্গী এসে হঠাৎ
জানালো তিরুমলের বিছানা শূন্য। তাঁবুর
মধ্যে কোথাও সে নেই।
কথাটা শুনে সবাই চমকে উঠল। শঙ্করও
নিজে তাঁবুর মধ্যে ঢুকে দেখে এল সত্যিই
সেখানে কেউ নেই।
তখনি কুলিরা আলো জ্বেলে লাঠি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।
সব তাঁবুগুলোতে খোঁজ করা হল, নাম ধরে চিৎকার
করে ডাকাডাকি করলে সবাই মিলে—
তিরুমলের কোনো সাড়া মিলল না।
তিরুমল যেখানটাতে শুয়ে ছিল,
সেখানটাতে ভালো করে দেখা গেল তখন।
কোনো একটা ভারী জিনিসকে টেনে নিয়ে যাওয়ার
দাগ মাটির ওপর সুস্পষ্ট।
ব্যাপারটা বুঝতে কারো দেরি হল না। বাওবাব
গাছের কাছে তিরুমলের জামার হাতার
খানিকটা টুকরো পাওয়া গেল। এঞ্জিনিয়ার
সাহেব বন্দুক নিয়ে আগে আগে চললেন, শঙ্কর
তাঁর সঙ্গে চলল। কুলিরা তাঁদের অনুসরণ
করতে লাগল। সেই গভীর রাত্রে তাঁবু
থেকে দূরে মাঠের চারিদিকে অনেক
জায়গা খোঁজা হল, তিরুমলের দেহের কোনো সন্ধান
মিলল না। এবার আবার সিংহগর্জন শোনা গেল—
কিন্তু দূরে। যেন এই নির্জন প্রান্তরের
অধিষ্ঠাত্রী কোনো রহস্যময়ী রাক্ষসীর বিকট
চিৎকার।
মাসাই কুলিটা বললে— সিংহ দেহ
নিয়ে চলে যাচ্ছে। কিন্তু ওকে নিয়ে আমাদের
ভুগতে হবে। আরও অনেকগুলো মানুষ ও ঘায়েল
না করে ছাড়বে না। সবাই সাবধান। যে সিংহ
একবার মানুষ খেতে শুরু করে সে অত্যন্ত ধূর্ত
হয়ে ওঠে।
রাত যখন প্রায় তিনটে তখন সবাই ফিরল
তাঁবুতে। বেশ ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় সারা মাঠ
আলো হয়ে উঠেছে। আফ্রিকার এই
অংশে পাখি বড় একটা দেখা যায় না দিনমানে,
কিন্তু এক ধরণের রাত্রিচর পাখির ডাক
শুনতে পাওয়া যায় রাত্রে— সে সুর অপার্থিব
ধরণের মিষ্টি। এইমাত্র সেই পাখি কোনো গাছের
মাথায় বহুদূরে ডেকে উঠল। মনটা এক মুহূর্তে উদাস
করে দেয়। শঙ্কর ঘুমুতে গেল না। আর সবাই তাঁবুর
মধ্যে শুতে গেল কারণ পরিশ্রম কারো কম হয়নি।
তাঁবুর সামনে কাঠকুটো জ্বালিয়ে প্রকান্ড
অগ্নিকুণ্ড করা হল। শঙ্কর সাহস
করে বাইরে বসতে অবিশ্যি পারলে না— এ রকম
দুঃসাহসের কোনো অর্থ হয় না। তবে সে নিজের
ঘরে শুয়ে জানলা দিয়ে বিস্তৃত
জ্যোৎস্নালোকিত অজানা প্রান্তরের
দিকে চেয়ে রইল।
মনে কি এক অদ্ভুত ভাব। তিরুমলের
অদৃষ্টলিপি এইজন্যেই বোধ হয়
তাকে আফ্রিকায় টেনে এনেছিল। তাকেই
বা কি জন্যে এখানে এনেছে তার অদৃষ্ট,
কে জানে তার খবর?
আফ্রিকা অদ্ভুত সুন্দর দেখতে— কিন্তু
আফ্রিকা ভয়ঙ্কর।
দেখতে বাবলা বনে ভর্তি বাঙলাদেশের মাঠের
মতো দেখালে কি হবে,
আফ্রিকা অজানা মৃত্যুসঙ্কুল!
যেখানে সেখানে অতর্কিত নিষ্ঠুর মৃত্যুর ফাঁদ
পাতা… পরমুহূর্তে কি ঘটবে, এ মুহূর্তে তা কেউ
বলতে পারে না।
আফ্রিকা প্রথম বলি গ্রহণ করেছে— তরুণ
হিন্দু যুবক তিরুমলকে। সে বলি চায়…
তিরুমল তো গেল, সঙ্গে সঙ্গে ক্যাম্পে পরদিন
থেকে এমন অবস্থা হয়ে উঠল যে আর
সেখানে সিংহের উপদ্রবে থাকা যায় না।
মানুষখেকো সিংহ অতি ভয়ানক জানোয়ার! যেমন
সে ধূর্ত, তেমনি সাহসী। সন্ধ্যা তো দূরের কথা,
দিনমানেই একা বেশিদূর যাওয়া যায় না।
সন্ধ্যার আগে তাঁবুর মাঠে নানা জায়গায় বড় বড়
আগুনের কুণ্ড করা হয়। কুলিরা আগুনের
কাছে ঘেঁষে বসে গল্প করে, রান্না করে,
সেখানে বসেই খাওয়া-দাওয়া করে।
এঞ্জিনিয়ার সাহেব বন্দুক হাতে রাত্রে তিন-
চারবার তাঁবুর চারদিকে ঘুরে পাহারা দেন,
ফাঁকা দ্যাওড় করেন— এত সতর্কতার মধ্যেও
একটা কুলিকে সিংহ নিয়ে পালাল
তিরুমলকে মারবার ঠিক দু’দিন
পরে সন্ধ্যারাত্রে।
তার পরদিন একটা সোমালি কুলি দুপুরে তাঁবু
থেকে তিনশো গজের মধ্যে পাথরের
ঢিবিতে পাথর ভাঙতে গেল— সন্ধ্যায় সে আর
ফিরে এল না।
সেই রাত্রেই, রাত দশটার পরে— শঙ্কর
এঞ্জিনিয়ার সাহেবের তাঁবু থেকে ফিরছে,
লোকজন কেউ বড় একটা বাইরে নেই, সকাল সকাল
যে যার ঘরে শুয়ে পড়েছে, কেবল এখানে ওখানে দু-
একটা নির্বাপিতপ্রায় অগ্নিকুণ্ড। দূরে শেয়াল
ডাকছে— শেয়ালের ডাক শুনলেই শঙ্করের মনে হয়
সে বাঙলাদেশের পাড়াগাঁয়ে আছে— চোখ
বুজে সে নিজের গ্রামটা ভাববার চেষ্টা করে,
তাদের ঘরের কোণের সেই
বিলিতি আমড়া গাছটা ভাববার চেষ্টা করে—
আজও সে একবার
থমকে দাঁড়িয়ে তাড়াতাড়ি চোখ বুজলে।
কি চমৎকার লাগে! কোথায় সে? সেই তাদের গাঁয়ের
বাড়ির জানলার পাশে তক্তপোশে শুয়ে?
বিলিতি আমড়া গাছটার ডালপালা চোখ
খুললেই চোখে পড়বে? ঠিক? দেখবে সে চোখ খুলে?
শঙ্কর ধীরে ধীরে চোখ খুললে।
অন্ধকার প্রান্তর। দূরে সেই বড় বাওবাব
গাছটা অস্পষ্ট অন্ধকারে দৈত্যের
মতো দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ তার মনে হল সামনের
একটা ছাতার মতো গোল খড়ের নিচু চালার
উপরে কি যেন একটা নড়ছে। পরক্ষণেই সে ভয়ে ও
বিস্ময়ে কাঠ হয়ে গেল।
প্রকান্ড একটা সিংহ খড়ের
চালা থাবা দিয়ে খুঁচিয়ে গর্ত করবার
চেষ্টা করছে ও মাঝেমাঝে নাকটা চালার গর্তের
কাছে নিয়ে গিয়ে কিসের যেন ঘ্রাণ নিচ্ছে!
তার কাছ থেকে চালাটার দূরত্ব বড় জোর বিশ
হাত।
শঙ্কর বুঝলে সে ভয়ানক বিপদগ্রস্ত। সিংহ
চালার খড় খুঁচিয়ে গর্ত করতে ব্যস্ত, সেখান
দিয়ে ঢুকে সে মানুষ নেবে—
শঙ্করকে সে এখনো দেখতে পায়নি। তাঁবুর
বাইরে কোথাও লোক নেই, সিংহের
ভয়ে বেশি রাত্রে কেউ বাইরে থাকে না।
নিজে সে সম্পূর্ণ নিরস্ত্র,
একগাছা লাঠি পর্যন্ত নেই হাতে।
শঙ্কর নিঃশব্দে পিছু হটতে লাগল
এঞ্জিনিয়ারের তাঁবুর দিকে, সিংহের
দিকে চোখ রেখে। এক মিনিট… দু’মিনিট…
নিজের স্নায়ুমণ্ডলীর উপর যে তার এত কর্তৃত্ব
ছিল, তা এর আগে শঙ্কর জানতো না।
একটা ভীতিসূচক শব্দ তার মুখ দিয়ে বেরুল
না বা সে হঠাৎ পিছু ফিরে দৌড় দেবার চেষ্টাও
করলে না।
এঞ্জিনিয়ারের তাঁবুর
পর্দা উঠিয়ে সে ঢুকে দেখল সাহেব
টেবিলে বসে তখনো কাজ করছে। সাহেব ওর রকম-
সকম দেখে বিস্মিত হয়ে কিছু জিজ্ঞেস
করবার আগেই ও বললে— সাহেব, সিংহ!
সাহেব লাফিয়ে উঠল— কৈ? কোথায়?
বন্দুকের র্যাকে একটা ৩৭৫ ম্যানলিকার
রাইফেল ছিল, সাহেব সেটা নামিয়ে নিল।
শঙ্করকে আর একটা রাইফেল দিল। দু’জনে তাঁবুর
পর্দা তুলে আস্তে আস্তে বাইরে এল। একটু দূরেই
কুলি লাইনের সেই গোল চালা। কিন্তু চালার
ওপর কোথায় সিংহ? শঙ্কর আঙুল
দিয়ে দেখিয়ে বললে, এই মাত্র দেখে গেলাম
স্যার। ঐ চালার উপর সিংহ থাবা দিয়ে খড়
খোঁচাচ্ছে।
সাহেব বললে— পালিয়েছে। জাগাও সবাইকে।
একটু পরে তাঁবুতে মহা সোরগোল পড়ে গেল। লাঠি,
সড়কি, গাঁতি, মুগুর নিয়ে কুলির দল
হল্লা করে বেরিয়ে পড়ল— খোঁজ খোঁজ
চারিদিকে, খড়ের চালা সত্যি ফুটো দেখা গেল।
সিংহের পায়ের দাগও পাওয়া গেল। কিন্তু সিংহ
উধাও হয়েছে। আগুনের কুণ্ডে বেশি করে কাঠ ও
শুকনো খড় ফেলে আগুন আবার জ্বালানো হল। সেই
রাত্রে অনেকেরই ভালো ঘুম হল না, তাঁবুর বাইরেও
বড় একটা কেউ রইল না। শেষ রাত্রের
দিকে শঙ্কর নিজের তাঁবুতে শুয়ে একটু
ঘুমিয়ে পড়েছিল— একটা মহা শোরগোলের
শব্দে তার ঘুম ভেঙে গেল। মাসাই
কুলিরা ‘সিম্বা’ ‘সিম্বা’ বলে চিৎকার করছে।
দু’বার বন্দুকের আওয়াজ হল। শঙ্কর তাঁবুর
বাইরে এসে ব্যাপার জিজ্ঞেস করে জানলে সিংহ
এসে আস্তাবলের
একটা ভারবাহী অশ্বতরকে জখম করে গিয়েছে—
এইমাত্র! সবাই শেষ রাত্রে একটু
ঝিমিয়ে পড়েছে আর সেই সময়ে এই কাণ্ড।
পরদিন সন্ধ্যার
ঝোঁকে একটা ছোকরা কুলিকে তাঁবু
থেকে একশো হাতের মধ্যে সিংহ নিয়ে গেল। দিন
চারেক পর আর একটা কুলিকে নিল বাওবাব
গাছটার তলা থেকে।
কুলিরা কেউ আর কাজ করতে চায় না।
লম্বা লাইনে গাঁতিওয়ালা কুলিদের অনেক
সময়ে খুব ছোট দলে ভাগ হয়ে কাজ করতে হয়—
তারা তাঁবু ছেড়ে দিনের বেলাতেও বেশি দূর
যেতে চায় না। তাঁবুর মধ্যে থাকাও
রাত্রে নিরাপদ নয়। সকলের মনে ভয়—
প্রত্যেকেই ভাবে এইবার তার পালা। কাকে কখন
নেবে কিছু স্থিরতা নেই। এই অবস্থায় কাজ হয়
না। কেবল মাসাই কুলিরা অবিচলিত রইল—
তারা যমকেও ভয় করে না। তাঁবু থেকে দু’মাইল
দূরে গাঁতির কাজ তারাই করে, সাহেব বন্দুক
নিয়ে দিনের মধ্যে চার-পাঁচবার তাদের
দেখাশোনা করে আসে।
কত নতুন ব্যবস্থা করা হল, কিছুতেই সিংহের
উপদ্রব কমল না। অত চেষ্টা করেও সিংহ শিকার
করা গেল না। অনেকে বললে সিংহ একটা নয়,
অনেকগুলো— ক’টা মেরে ফেলা যাবে? সাহেব
বললে— মানুষখেকো সিংহ বেশি থাকে না। এ
একটা সিংহেরই কাজ।
একদিন সাহেব
শঙ্করকে ডেকে বললে বন্দুকটা নিয়ে গাঁতিদার
কুলিদের একবার দেখে আসতে। শঙ্কর বললে—
সাহেব, তোমার ম্যানলিকারটা দাও।
সাহেব রাজী হল। শঙ্কর বন্দুক
নিয়ে একটা অশ্বতরে চড়ে রওনা হল— তাঁবু
থেকে মাইলখানেক দূরে এক জায়গায় একটা ছোট
জলা। শঙ্কর দূর থেকে জলাটা যখন
দেখতে পেয়েছে, তখন বেলা প্রায় তিনটে। কেউ
কোনো দিকে নেই, রোদের ঝাঁজ মাঠের মধ্যে তাপ-
তরঙ্গের সৃষ্টি করেছে।
হঠাৎ অশ্বতর থমকে দাঁড়িয়ে গেল। আর কিছুতেই
সেটা এগিয়ে যেতে চায় না। শঙ্করের মনে হল
জায়গাটার দিকে যেতে অশ্বতরটা ভয় পাচ্ছে।
একটু পরে পাশের ঝোপে কি যেন একটা নড়ল।
কিন্তু সেদিকে চেয়ে সে কিছু দেখতে পেলে না।
সে অশ্বতর থেকে নামল। তবুও অশ্বতর নড়তে চায়
না।
হঠাৎ শঙ্করের শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল।
ঝোপের মধ্যে সিংহ তার জন্যে ওৎ পেতে বসে নেই
তো? অনেক সময়ে এরকম হয় সে জানে, সিংহ পথের
পাশে ঝোপঝাড়ের মধ্যে লুকিয়ে অনেক দূর পর্যন্ত
নিঃশব্দে তার শিকারের অনুসরণ করে। নির্জন
স্থানে সুবিধে বুঝে তার ঘাড়ের উপর
লাফিয়ে পড়ে। যদি তাই হয়? শঙ্কর অশ্বতর
নিয়ে আর এগিয়ে যাওয়া উচিত
বিবেচনা করলে না। ভাবলে তাঁবুতে ফিরেই যাই।
সবে সে তাঁবুর দিকে অশ্বতরের
মুখটা ফিরিয়েছে এমন সময় আবার ঝোপের
মধ্যে কি একটা নড়ল। সঙ্গে সঙ্গে ভয়ানক সিংহ
গর্জন এবং একটা ধূসর বর্ণের বিরাট দেহ
সশব্দে অশ্বতরের উপর এসে পড়ল। শঙ্কর তখন
হাত চারেক এগিয়ে আছে,
সে তখুনি ফিরে দাঁড়িয়ে বন্দুক
উঁচিয়ে উপরি উপরি দু’বার গুলি করলে।
গুলি লেগেছে কিনা বোঝা গেল না, কিন্তু তখন
অশ্বতর মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে— ধূসর বর্ণের
জানোয়ারটা পলাতক। শঙ্কর
পরীক্ষা করে দেখলে অশ্বতরের কাঁধের
কাছে অনেকটা মাংস ছিন্নভিন্ন,
রক্তে মাটি ভেসে যাচ্ছে। যন্ত্রণায় সে ছটফট
করছে। শঙ্কর এক গুলিতে তার যন্ত্রণার অবসান
করলে।
তারপর সে তাঁবুতে ফিরে এল। সাহেব বললে—
সিংহ নিশ্চয়ই জখম হয়েছে। বন্দুকের
গুলি যদি গায়ে লাগে তবে দস্তুরমতো জখম
তাকে হতেই হবে। কিন্তু গুলি লেগেছিল তো?
শঙ্কর বললে— গুলি লাগালাগির
কথা সে বলতে পারে না। বন্দুক ছুঁড়েছিল, এই
মাত্র কথা। লোকজন নিয়ে খোঁজাখুঁজি করে দু-
তিনদিনেও কোনো আহত বা মৃত সিংহের সন্ধান
কোথাও পাওয়া গেল না।
জুন মাসের প্রথম থেকে বর্ষা নামল।
কতকটা সিংহের উপদ্রবের জন্যে,
কতকটা বা জলাভূমির সান্নিধ্যের
জন্যে জায়গাটা অস্বাস্থ্যকর হওয়ায় তাঁবু ওখান
থেকে উঠে গেল।
শঙ্করকে আর কনস্ট্রাকশন তাঁবুতে থাকতে হল
না। কিসুমু থেকে প্রায় ত্রিশ মাইল
দূরে একটা ছোট স্টেশনে সে স্টেশন মাস্টারের
কাজ পেয়ে জিনিসপত্র নিয়ে সেখানেই
চলে গেল।

Posted by
Unknown

More

handapeunpost

Copyright © / Echoapk

Template by : Urang-kurai / powered by :blogger