০২. চাঁদের পাহাড় - দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

০২. চাঁদের পাহাড় - দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ


চার মাস পরের ঘটনা। মার্চ মাসের শেষ।

মোম্বাসা থেকে রেলপথ গিয়েছে কিসুমু-
ভিক্টোরিয়া নায়ানজা হ্রদের ধারে— তারই
একটা শাখা লাইন তখন তৈরি হচ্ছিল।
জায়গাটা মোম্বাসা থেকে সাড়ে তিনশো মাইল
পশ্চিমে। ইউগাণ্ডা রেলওয়ের নুডসবার্গ স্টেশন
থেকে বাহাত্তর মাইল দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে।
এখানে শঙ্কর কনস্ট্রাকশন ক্যাম্পের কেরানি ও
সরকারি স্টোরকিপার হয়ে এসেছে। থাকে ছোট
একটা তাঁবুতে। তার আশেপাশে অনেক তাঁবু।
এখানে এখনও বাড়িঘর
তৈরি হয়নি বলে তাঁবুতেই সবাই থাকে।
তাঁবুগুলো একটা খোলা জায়গায়
চক্রাকারে সাজানো— তাদের চারধার ঘিরে বহু
দূরব্যাপী মুক্ত প্রান্তর,
লম্বা লম্বা ঘাসে ভরা, মাঝে মাঝে গাছ।
তাঁবুগুলোর ঠিক গায়েই খোলা জায়গার শেষ
সীমায় একটা বড় বাওবাব গাছ। আফ্রিকার
বিখ্যাত গাছ, শঙ্কর কতবার ছবিতে দেখেছে,
এবার সত্যিকার বাওবাব দেখে শঙ্করের যেন আশ
মেটে না।
নতুন দেশ, শঙ্করের তরুণ তাজা মন—
সে ইউগান্ডার এই নির্জন মাঠ ও বনে নিজের
স্বপ্নের সার্থকতাকে যেন খুঁজে পেলে। কাজ শেষ
হয়ে যেতেই সে তাঁবু থেকে রোজ বেরিয়ে পড়তো—
যেদিকে দু’চোখ যায় সেদিকে বেড়াতে বের হত—
পুবে, পশ্চিমে, দক্ষিণে, উত্তরে। সব দিকেই
লম্বা লম্বা ঘাস। কোথাও মানুষের মাথা সমান
উঁচু, কোথাও তার চেয়েও উঁচু।
কনস্ট্রাকশন তাঁবুর ভারপ্রাপ্ত এঞ্জিনিয়ার
সাহেব একদিন শঙ্করকে ডেকে বললেন—
শোনো রায়, ওরকম এখানে বেড়িও না।
বিনা বন্দুকে এখানে এক পা-ও যেও না। প্রথম—
এই ঘাসের জমিতে পথ হারাতে পারো। পথ
হারিয়ে লোকে এসব জায়গায় মারাও
গিয়েছে জলের অভাবে। দ্বিতীয়—
ইউগান্ডা সিংহের দেশ। এখানে আমাদের
সাড়াশব্দ আর হাতুড়ি ঠোকার আওয়াজে সিংহ
হয়তো একটু দূরে চলে গিয়েছে— কিন্তু ওদের
বিশ্বাস নেই। খুব সাবধান। এসব অঞ্চল মোটেই
নিরাপদ নয়।
একদিন দুপুরের পরে কাজকর্ম বেশ পুরোদমে চলছে,
হঠাৎ তাঁবু থেকে কিছুদূরে লম্বা ঘাসের জমির
মধ্যে মনুষ্যকণ্ঠের আর্তনাদ শোনা গেল। সবাই
সেদিকে ছুটে গেল ব্যাপার কী দেখতে। শঙ্করও
ছুটল। ঘাসের জমি পাতিপাতি করে খোঁজা হল—
কিছুই নেই সেখানে।
কিসের চিৎকার তবে?
এঞ্জিনিয়ার সাহেব এলেন। কুলিদের নামডাক
হল, দেখা গেল একজন কুলি অনুপস্থিত।
অনুসন্ধানে জানা গেল সে একটু আগে ঘাসের
বনের দিকে কি কাজে গিয়েছিল,
তাকে ফিরে আসতে কেউ দেখেনি।
খোঁজাখুঁজি করতে করতে ঘাসের বনের
বাইরে কটা বালির ওপরে সিংহের পায়ের দাগ
পাওয়া গেল। সাহেব বন্দুক নিয়ে লোকজন
সঙ্গে করে পায়ের দাগ দেখে অনেক দূর
গিয়ে একটা বড় পাথরের আড়ালে হতভাগ্য
কুলির রক্তাক্ত দেহ বার করলেন।
তাকে তাঁবুতে ধরাধরি করে নিয়ে আসা হল।
কিন্তু সিংহের কোনো চিহ্ন মিলল না। লোকজনের
চিৎকারে সে শিকার ফেলে পালিয়েছে। সন্ধ্যার
আগেই কুলিটা মারা গেল।
তাঁবুর চারপাশের লম্বা ঘাস অনেক দূর পর্যন্ত
কেটে সাফ করে দেওয়া হল পরদিনই। দিনকতক
সিংহের কথা ছাড়া তাঁবুতে আর কোনো গল্পই নেই।
তারপর মাসখানেক পরে ঘটনাটা পুরনো হয়ে গেল,
সে কথা সকলের মনে চাপা পড়ে গেল। কাজকর্ম
আবার বেশ চলল।
সেদিন দিনে খুব গরম। সন্ধ্যার একটু পরেই
কিন্তু ঠাণ্ডা পড়ল। কুলিদের তাঁবুর
সামনে কাঠকুটো জ্বালিয়ে আগুন করা হয়েছে।
সেখানে তাঁবুর সবাই গোল হয়ে বসে গল্পগুজব
করছে। শঙ্করও সেখানে আছে, সে ওদের গল্প
শুনছে এবং অগ্নিকুণ্ডের
আলোতে ‘কেনিয়া মর্নিং নিউজ’ পড়ছে। খবরের
কাগজখানা পাঁচদিনের পুরনো। কিন্তু এ জনহীন
প্রান্তরে তবু এখানাতে বাইরের দুনিয়ার
যা কিছু একটা খবর পাওয়া যায়।
তিরুমল আপ্পা বলে একজন
মাদ্রাজি কেরানির সঙ্গে শঙ্করের খুব বন্ধুত্ব
হয়েছিল। তিরুমল তরুণ যুবক, বেশ ইংরেজী জানে,
মনেও খুব উৎসাহ।
সে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে এ্যাডভেঞ্চারের
নেশায়। শঙ্করের পাশে বসে সে আজ
সন্ধ্যা থেকে ক্রমাগত দেশের কথা, তার বাপ-
মায়ের কথা, তার ছোট বোনের কথা বলছে। ছোট
বোনকে সে বড় ভালোবাসে। বাড়ি ছেড়ে এসে তার
কথাই তিরুমলের বড় মনে হয়। একবার সে দেশের
দিকে যাবে সেপ্টেম্বর মাসের শেষে। মাস দুই
ছুটি মঞ্জুর করবে না সাহেব?
ক্রমে রাত বেশি হল। মাঝে মাঝে আগুন
নিভে যাচ্ছে, আবার
কুলিরা তাতে কাঠকুটো ফেলে দিচ্ছে। আরও
অনেকে উঠে শুতে গেল। কৃষ্ণপক্ষের ভাঙা চাঁদ
ধীরে ধীরে দূর দিগন্তে দেখা দিল— সমগ্র
প্রান্তর জুড়ে আলো-আঁধারের লুকোচুরি আর
বুনো গাছের দীর্ঘ দীর্ঘ ছায়া।
শঙ্করের ভারি অদ্ভুত মনে হচ্ছিল বহুদূর
বিদেশের এই স্তব্ধ রাত্রির সৌন্দর্য। কুলিদের
ঘরের একটা খুঁটিতে হেলান
দিয়ে সে একদৃষ্টে সম্মুখের বিশাল জনহীন
তৃণভূমির আলো-আঁধারমাখা রূপের
দিকে চেয়ে চেয়ে কত কি ভাবছিল। ওই বাওবাব
গাছটার ওদিকে অজানা দেশের সীমা কেপটাউন
পর্যন্ত বিস্তৃত— মধ্যে পড়বে কত পর্বত, অরণ্য,
প্রাগৈতিহাসিক যুগের নগর জিম্বারি—
বিশাল ও বিভীষিকাময় কালাহারি মরুভূমি,
হীরকের দেশ, সোনার খনির দেশ!
একজন বড় স্বর্ণাণ্বেষী পর্যটক
যেতে যেতে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলেন।
যে পাথরটাতে লেগে হোঁচট খেলেন
সেটা হাতে তুলে ভালো করে পরীক্ষা করে দেখলেন,
তার সঙ্গে সোনা মেশানো রয়েছে। সে জায়গায় বড়
একটা সোনার খনি বেরিয়ে পড়ল। এ ধরণের কত
গল্প সে পড়েছে দেশে থাকতে।
এই সেই আফ্রিকা, সেই রহস্যময় মহাদেশ, সোনার
দেশ, হীরের দেশ— কত অজানা জাতি,
অজানা দৃশ্যাবলী, অজানা জীবজন্তু এর
সীমাহীন ট্রপিক্যাল অরণ্যে আত্মগোপন
করে আছে, কে তার হিসেব রেখেছে?
কত কি ভাবতে ভাবতে শঙ্কর কখন
ঘুমিয়ে পড়েছে। হঠাৎ কিসের শব্দে তার ঘুম
ভাঙল। সে ধড়মড় করে জেগে উঠে বসল। চাঁদ
আকাশে অনেকটা উঠেছে।
ধবধবে সাদা জ্যোৎস্না দিনের মতো পরিস্কার।
অগ্নিকুণ্ডের আগুন গিয়েছে নিভে। কুলিরা সব
কুন্ডলি পাকিয়ে আগুনের উপরে শুয়ে আছে।
কোনোদিকে কোনো শব্দ নেই।
হঠাৎ শঙ্করের দৃষ্টি পড়ল তার পাশে—
এখানে তো তিরুমল আপ্পা বসে তার সঙ্গে গল্প
করছিল। সে কোথায়? তাহলে সে তাঁবুর
মধ্যে ঘুমুতে গিয়ে থাকবে।
শঙ্করও নিজে উঠে শুতে যাবার উদ্যোগ করছে,
এমন সময়ে অল্প দূরেই পশ্চিম কোণে মাঠের
মধ্যে ভীষণ সিংহগর্জন শুনতে পাওয়া গেল।
রাত্রির অস্পষ্ট জ্যোৎস্নালোক যেন কেঁপে উঠল
সে রবে। কুলিরা ধড়মড় করে জেগে উঠল।
এঞ্জিনিয়ার সাহেব বন্দুক নিয়ে তাঁবুর
বাইরে এলেন। শঙ্কর জীবনে এই প্রথম শুনল
সিংহের গর্জন— সেই দিকদিশাহীন তৃণভূমির
মধ্যে শেষ রাত্রের জ্যোৎস্নায় সে গর্জন
যে কি এক অনির্দেশ্য অনুভূতি তার
মনে জাগালে! তা ভয় নয়, সে এক রহস্যময় জটিল
মনোভাব। একজন বৃদ্ধ মাসাই কুলি ছিল তাঁবুতে।
সে বললে— সিংহ লোক মেরেছে। লোক
না মারলে এমন গর্জন করবে না।
তাঁবুর ভিতর থেকে তিরুমলের সঙ্গী এসে হঠাৎ
জানালো তিরুমলের বিছানা শূন্য। তাঁবুর
মধ্যে কোথাও সে নেই।
কথাটা শুনে সবাই চমকে উঠল। শঙ্করও
নিজে তাঁবুর মধ্যে ঢুকে দেখে এল সত্যিই
সেখানে কেউ নেই।
তখনি কুলিরা আলো জ্বেলে লাঠি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।
সব তাঁবুগুলোতে খোঁজ করা হল, নাম ধরে চিৎকার
করে ডাকাডাকি করলে সবাই মিলে—
তিরুমলের কোনো সাড়া মিলল না।
তিরুমল যেখানটাতে শুয়ে ছিল,
সেখানটাতে ভালো করে দেখা গেল তখন।
কোনো একটা ভারী জিনিসকে টেনে নিয়ে যাওয়ার
দাগ মাটির ওপর সুস্পষ্ট।
ব্যাপারটা বুঝতে কারো দেরি হল না। বাওবাব
গাছের কাছে তিরুমলের জামার হাতার
খানিকটা টুকরো পাওয়া গেল। এঞ্জিনিয়ার
সাহেব বন্দুক নিয়ে আগে আগে চললেন, শঙ্কর
তাঁর সঙ্গে চলল। কুলিরা তাঁদের অনুসরণ
করতে লাগল। সেই গভীর রাত্রে তাঁবু
থেকে দূরে মাঠের চারিদিকে অনেক
জায়গা খোঁজা হল, তিরুমলের দেহের কোনো সন্ধান
মিলল না। এবার আবার সিংহগর্জন শোনা গেল—
কিন্তু দূরে। যেন এই নির্জন প্রান্তরের
অধিষ্ঠাত্রী কোনো রহস্যময়ী রাক্ষসীর বিকট
চিৎকার।
মাসাই কুলিটা বললে— সিংহ দেহ
নিয়ে চলে যাচ্ছে। কিন্তু ওকে নিয়ে আমাদের
ভুগতে হবে। আরও অনেকগুলো মানুষ ও ঘায়েল
না করে ছাড়বে না। সবাই সাবধান। যে সিংহ
একবার মানুষ খেতে শুরু করে সে অত্যন্ত ধূর্ত
হয়ে ওঠে।
রাত যখন প্রায় তিনটে তখন সবাই ফিরল
তাঁবুতে। বেশ ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় সারা মাঠ
আলো হয়ে উঠেছে। আফ্রিকার এই
অংশে পাখি বড় একটা দেখা যায় না দিনমানে,
কিন্তু এক ধরণের রাত্রিচর পাখির ডাক
শুনতে পাওয়া যায় রাত্রে— সে সুর অপার্থিব
ধরণের মিষ্টি। এইমাত্র সেই পাখি কোনো গাছের
মাথায় বহুদূরে ডেকে উঠল। মনটা এক মুহূর্তে উদাস
করে দেয়। শঙ্কর ঘুমুতে গেল না। আর সবাই তাঁবুর
মধ্যে শুতে গেল কারণ পরিশ্রম কারো কম হয়নি।
তাঁবুর সামনে কাঠকুটো জ্বালিয়ে প্রকান্ড
অগ্নিকুণ্ড করা হল। শঙ্কর সাহস
করে বাইরে বসতে অবিশ্যি পারলে না— এ রকম
দুঃসাহসের কোনো অর্থ হয় না। তবে সে নিজের
ঘরে শুয়ে জানলা দিয়ে বিস্তৃত
জ্যোৎস্নালোকিত অজানা প্রান্তরের
দিকে চেয়ে রইল।
মনে কি এক অদ্ভুত ভাব। তিরুমলের
অদৃষ্টলিপি এইজন্যেই বোধ হয়
তাকে আফ্রিকায় টেনে এনেছিল। তাকেই
বা কি জন্যে এখানে এনেছে তার অদৃষ্ট,
কে জানে তার খবর?
আফ্রিকা অদ্ভুত সুন্দর দেখতে— কিন্তু
আফ্রিকা ভয়ঙ্কর।
দেখতে বাবলা বনে ভর্তি বাঙলাদেশের মাঠের
মতো দেখালে কি হবে,
আফ্রিকা অজানা মৃত্যুসঙ্কুল!
যেখানে সেখানে অতর্কিত নিষ্ঠুর মৃত্যুর ফাঁদ
পাতা… পরমুহূর্তে কি ঘটবে, এ মুহূর্তে তা কেউ
বলতে পারে না।
আফ্রিকা প্রথম বলি গ্রহণ করেছে— তরুণ
হিন্দু যুবক তিরুমলকে। সে বলি চায়…
তিরুমল তো গেল, সঙ্গে সঙ্গে ক্যাম্পে পরদিন
থেকে এমন অবস্থা হয়ে উঠল যে আর
সেখানে সিংহের উপদ্রবে থাকা যায় না।
মানুষখেকো সিংহ অতি ভয়ানক জানোয়ার! যেমন
সে ধূর্ত, তেমনি সাহসী। সন্ধ্যা তো দূরের কথা,
দিনমানেই একা বেশিদূর যাওয়া যায় না।
সন্ধ্যার আগে তাঁবুর মাঠে নানা জায়গায় বড় বড়
আগুনের কুণ্ড করা হয়। কুলিরা আগুনের
কাছে ঘেঁষে বসে গল্প করে, রান্না করে,
সেখানে বসেই খাওয়া-দাওয়া করে।
এঞ্জিনিয়ার সাহেব বন্দুক হাতে রাত্রে তিন-
চারবার তাঁবুর চারদিকে ঘুরে পাহারা দেন,
ফাঁকা দ্যাওড় করেন— এত সতর্কতার মধ্যেও
একটা কুলিকে সিংহ নিয়ে পালাল
তিরুমলকে মারবার ঠিক দু’দিন
পরে সন্ধ্যারাত্রে।
তার পরদিন একটা সোমালি কুলি দুপুরে তাঁবু
থেকে তিনশো গজের মধ্যে পাথরের
ঢিবিতে পাথর ভাঙতে গেল— সন্ধ্যায় সে আর
ফিরে এল না।
সেই রাত্রেই, রাত দশটার পরে— শঙ্কর
এঞ্জিনিয়ার সাহেবের তাঁবু থেকে ফিরছে,
লোকজন কেউ বড় একটা বাইরে নেই, সকাল সকাল
যে যার ঘরে শুয়ে পড়েছে, কেবল এখানে ওখানে দু-
একটা নির্বাপিতপ্রায় অগ্নিকুণ্ড। দূরে শেয়াল
ডাকছে— শেয়ালের ডাক শুনলেই শঙ্করের মনে হয়
সে বাঙলাদেশের পাড়াগাঁয়ে আছে— চোখ
বুজে সে নিজের গ্রামটা ভাববার চেষ্টা করে,
তাদের ঘরের কোণের সেই
বিলিতি আমড়া গাছটা ভাববার চেষ্টা করে—
আজও সে একবার
থমকে দাঁড়িয়ে তাড়াতাড়ি চোখ বুজলে।
কি চমৎকার লাগে! কোথায় সে? সেই তাদের গাঁয়ের
বাড়ির জানলার পাশে তক্তপোশে শুয়ে?
বিলিতি আমড়া গাছটার ডালপালা চোখ
খুললেই চোখে পড়বে? ঠিক? দেখবে সে চোখ খুলে?
শঙ্কর ধীরে ধীরে চোখ খুললে।
অন্ধকার প্রান্তর। দূরে সেই বড় বাওবাব
গাছটা অস্পষ্ট অন্ধকারে দৈত্যের
মতো দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ তার মনে হল সামনের
একটা ছাতার মতো গোল খড়ের নিচু চালার
উপরে কি যেন একটা নড়ছে। পরক্ষণেই সে ভয়ে ও
বিস্ময়ে কাঠ হয়ে গেল।
প্রকান্ড একটা সিংহ খড়ের
চালা থাবা দিয়ে খুঁচিয়ে গর্ত করবার
চেষ্টা করছে ও মাঝেমাঝে নাকটা চালার গর্তের
কাছে নিয়ে গিয়ে কিসের যেন ঘ্রাণ নিচ্ছে!
তার কাছ থেকে চালাটার দূরত্ব বড় জোর বিশ
হাত।
শঙ্কর বুঝলে সে ভয়ানক বিপদগ্রস্ত। সিংহ
চালার খড় খুঁচিয়ে গর্ত করতে ব্যস্ত, সেখান
দিয়ে ঢুকে সে মানুষ নেবে—
শঙ্করকে সে এখনো দেখতে পায়নি। তাঁবুর
বাইরে কোথাও লোক নেই, সিংহের
ভয়ে বেশি রাত্রে কেউ বাইরে থাকে না।
নিজে সে সম্পূর্ণ নিরস্ত্র,
একগাছা লাঠি পর্যন্ত নেই হাতে।
শঙ্কর নিঃশব্দে পিছু হটতে লাগল
এঞ্জিনিয়ারের তাঁবুর দিকে, সিংহের
দিকে চোখ রেখে। এক মিনিট… দু’মিনিট…
নিজের স্নায়ুমণ্ডলীর উপর যে তার এত কর্তৃত্ব
ছিল, তা এর আগে শঙ্কর জানতো না।
একটা ভীতিসূচক শব্দ তার মুখ দিয়ে বেরুল
না বা সে হঠাৎ পিছু ফিরে দৌড় দেবার চেষ্টাও
করলে না।
এঞ্জিনিয়ারের তাঁবুর
পর্দা উঠিয়ে সে ঢুকে দেখল সাহেব
টেবিলে বসে তখনো কাজ করছে। সাহেব ওর রকম-
সকম দেখে বিস্মিত হয়ে কিছু জিজ্ঞেস
করবার আগেই ও বললে— সাহেব, সিংহ!
সাহেব লাফিয়ে উঠল— কৈ? কোথায়?
বন্দুকের র্যাকে একটা ৩৭৫ ম্যানলিকার
রাইফেল ছিল, সাহেব সেটা নামিয়ে নিল।
শঙ্করকে আর একটা রাইফেল দিল। দু’জনে তাঁবুর
পর্দা তুলে আস্তে আস্তে বাইরে এল। একটু দূরেই
কুলি লাইনের সেই গোল চালা। কিন্তু চালার
ওপর কোথায় সিংহ? শঙ্কর আঙুল
দিয়ে দেখিয়ে বললে, এই মাত্র দেখে গেলাম
স্যার। ঐ চালার উপর সিংহ থাবা দিয়ে খড়
খোঁচাচ্ছে।
সাহেব বললে— পালিয়েছে। জাগাও সবাইকে।
একটু পরে তাঁবুতে মহা সোরগোল পড়ে গেল। লাঠি,
সড়কি, গাঁতি, মুগুর নিয়ে কুলির দল
হল্লা করে বেরিয়ে পড়ল— খোঁজ খোঁজ
চারিদিকে, খড়ের চালা সত্যি ফুটো দেখা গেল।
সিংহের পায়ের দাগও পাওয়া গেল। কিন্তু সিংহ
উধাও হয়েছে। আগুনের কুণ্ডে বেশি করে কাঠ ও
শুকনো খড় ফেলে আগুন আবার জ্বালানো হল। সেই
রাত্রে অনেকেরই ভালো ঘুম হল না, তাঁবুর বাইরেও
বড় একটা কেউ রইল না। শেষ রাত্রের
দিকে শঙ্কর নিজের তাঁবুতে শুয়ে একটু
ঘুমিয়ে পড়েছিল— একটা মহা শোরগোলের
শব্দে তার ঘুম ভেঙে গেল। মাসাই
কুলিরা ‘সিম্বা’ ‘সিম্বা’ বলে চিৎকার করছে।
দু’বার বন্দুকের আওয়াজ হল। শঙ্কর তাঁবুর
বাইরে এসে ব্যাপার জিজ্ঞেস করে জানলে সিংহ
এসে আস্তাবলের
একটা ভারবাহী অশ্বতরকে জখম করে গিয়েছে—
এইমাত্র! সবাই শেষ রাত্রে একটু
ঝিমিয়ে পড়েছে আর সেই সময়ে এই কাণ্ড।
পরদিন সন্ধ্যার
ঝোঁকে একটা ছোকরা কুলিকে তাঁবু
থেকে একশো হাতের মধ্যে সিংহ নিয়ে গেল। দিন
চারেক পর আর একটা কুলিকে নিল বাওবাব
গাছটার তলা থেকে।
কুলিরা কেউ আর কাজ করতে চায় না।
লম্বা লাইনে গাঁতিওয়ালা কুলিদের অনেক
সময়ে খুব ছোট দলে ভাগ হয়ে কাজ করতে হয়—
তারা তাঁবু ছেড়ে দিনের বেলাতেও বেশি দূর
যেতে চায় না। তাঁবুর মধ্যে থাকাও
রাত্রে নিরাপদ নয়। সকলের মনে ভয়—
প্রত্যেকেই ভাবে এইবার তার পালা। কাকে কখন
নেবে কিছু স্থিরতা নেই। এই অবস্থায় কাজ হয়
না। কেবল মাসাই কুলিরা অবিচলিত রইল—
তারা যমকেও ভয় করে না। তাঁবু থেকে দু’মাইল
দূরে গাঁতির কাজ তারাই করে, সাহেব বন্দুক
নিয়ে দিনের মধ্যে চার-পাঁচবার তাদের
দেখাশোনা করে আসে।
কত নতুন ব্যবস্থা করা হল, কিছুতেই সিংহের
উপদ্রব কমল না। অত চেষ্টা করেও সিংহ শিকার
করা গেল না। অনেকে বললে সিংহ একটা নয়,
অনেকগুলো— ক’টা মেরে ফেলা যাবে? সাহেব
বললে— মানুষখেকো সিংহ বেশি থাকে না। এ
একটা সিংহেরই কাজ।
একদিন সাহেব
শঙ্করকে ডেকে বললে বন্দুকটা নিয়ে গাঁতিদার
কুলিদের একবার দেখে আসতে। শঙ্কর বললে—
সাহেব, তোমার ম্যানলিকারটা দাও।
সাহেব রাজী হল। শঙ্কর বন্দুক
নিয়ে একটা অশ্বতরে চড়ে রওনা হল— তাঁবু
থেকে মাইলখানেক দূরে এক জায়গায় একটা ছোট
জলা। শঙ্কর দূর থেকে জলাটা যখন
দেখতে পেয়েছে, তখন বেলা প্রায় তিনটে। কেউ
কোনো দিকে নেই, রোদের ঝাঁজ মাঠের মধ্যে তাপ-
তরঙ্গের সৃষ্টি করেছে।
হঠাৎ অশ্বতর থমকে দাঁড়িয়ে গেল। আর কিছুতেই
সেটা এগিয়ে যেতে চায় না। শঙ্করের মনে হল
জায়গাটার দিকে যেতে অশ্বতরটা ভয় পাচ্ছে।
একটু পরে পাশের ঝোপে কি যেন একটা নড়ল।
কিন্তু সেদিকে চেয়ে সে কিছু দেখতে পেলে না।
সে অশ্বতর থেকে নামল। তবুও অশ্বতর নড়তে চায়
না।
হঠাৎ শঙ্করের শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল।
ঝোপের মধ্যে সিংহ তার জন্যে ওৎ পেতে বসে নেই
তো? অনেক সময়ে এরকম হয় সে জানে, সিংহ পথের
পাশে ঝোপঝাড়ের মধ্যে লুকিয়ে অনেক দূর পর্যন্ত
নিঃশব্দে তার শিকারের অনুসরণ করে। নির্জন
স্থানে সুবিধে বুঝে তার ঘাড়ের উপর
লাফিয়ে পড়ে। যদি তাই হয়? শঙ্কর অশ্বতর
নিয়ে আর এগিয়ে যাওয়া উচিত
বিবেচনা করলে না। ভাবলে তাঁবুতে ফিরেই যাই।
সবে সে তাঁবুর দিকে অশ্বতরের
মুখটা ফিরিয়েছে এমন সময় আবার ঝোপের
মধ্যে কি একটা নড়ল। সঙ্গে সঙ্গে ভয়ানক সিংহ
গর্জন এবং একটা ধূসর বর্ণের বিরাট দেহ
সশব্দে অশ্বতরের উপর এসে পড়ল। শঙ্কর তখন
হাত চারেক এগিয়ে আছে,
সে তখুনি ফিরে দাঁড়িয়ে বন্দুক
উঁচিয়ে উপরি উপরি দু’বার গুলি করলে।
গুলি লেগেছে কিনা বোঝা গেল না, কিন্তু তখন
অশ্বতর মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে— ধূসর বর্ণের
জানোয়ারটা পলাতক। শঙ্কর
পরীক্ষা করে দেখলে অশ্বতরের কাঁধের
কাছে অনেকটা মাংস ছিন্নভিন্ন,
রক্তে মাটি ভেসে যাচ্ছে। যন্ত্রণায় সে ছটফট
করছে। শঙ্কর এক গুলিতে তার যন্ত্রণার অবসান
করলে।
তারপর সে তাঁবুতে ফিরে এল। সাহেব বললে—
সিংহ নিশ্চয়ই জখম হয়েছে। বন্দুকের
গুলি যদি গায়ে লাগে তবে দস্তুরমতো জখম
তাকে হতেই হবে। কিন্তু গুলি লেগেছিল তো?
শঙ্কর বললে— গুলি লাগালাগির
কথা সে বলতে পারে না। বন্দুক ছুঁড়েছিল, এই
মাত্র কথা। লোকজন নিয়ে খোঁজাখুঁজি করে দু-
তিনদিনেও কোনো আহত বা মৃত সিংহের সন্ধান
কোথাও পাওয়া গেল না।
জুন মাসের প্রথম থেকে বর্ষা নামল।
কতকটা সিংহের উপদ্রবের জন্যে,
কতকটা বা জলাভূমির সান্নিধ্যের
জন্যে জায়গাটা অস্বাস্থ্যকর হওয়ায় তাঁবু ওখান
থেকে উঠে গেল।
শঙ্করকে আর কনস্ট্রাকশন তাঁবুতে থাকতে হল
না। কিসুমু থেকে প্রায় ত্রিশ মাইল
দূরে একটা ছোট স্টেশনে সে স্টেশন মাস্টারের
কাজ পেয়ে জিনিসপত্র নিয়ে সেখানেই
চলে গেল।

0 comments:

Post a Comment

handapeunpost

Copyright © / Echoapk

Template by : Urang-kurai / powered by :blogger